২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বর্ষায় কতটা প্রস্তুত ঢাকা?

-

বছর কয়েক আগেও ঘণ্টাখানেকের প্রবল বর্ষণে ঢাকা মহানগরী এত বেশি জলমগ্ন হতো না, কিন্তু এখন এক-দুই ঘণ্টার ভারী বর্ষণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। ঢাকার বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে গত কয়েক বছরে অন্যতম একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জলাবদ্ধতা।
এর ফলে মানুষকে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এবার বর্ষা ঋতু শুরুর বেশ আগে থেকেই বর্ষণ শুরু হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ঢাকা মহানগরী
কতটুকু প্রস্তুত সেই প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন মাহমুদুল হাসান

এই নগরে বৃষ্টি ছাড়াই মানুষের অনেক মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে যানজটের কারণে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘নগর পরিস্থিতি’ শীর্ষক ২০১৫-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যস্ত সময়ে ঢাকা নগরীতে গাড়ির গড় গতিবেগ ২০০৪ সালে ঘণ্টাপ্রতি ২১ দশমিক দুই কিলোমিটার থেকে নেমে ২০১৫ সালে ছয় দশমিক আট কিলোমিটারে এসে পৌঁছেছে, যা হাঁটার গতির থেকে একটু বেশি। সম্প্রতি বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় দেখা যায়, যানজটের কারণে ব্যস্ত সময়ে রাজধানীতে গণপরিবহনের গতি এখন ঘণ্টায় গড়ে পাঁচ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এটি হাঁটার গতির সমান। এ পরিস্থিতিতে বৃষ্টিতে ঢাকা জলমগ্ন হলে প্রকট যানজটে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। রাজধানীজুড়ে চলাচল প্রায় অচল হয়ে যায়।
জলাবদ্ধতার কারণ
নগরীর মাটির ৮০-৯০ শতাংশ কংক্রিটে ঢাকা পড়েছে, তাই মাটির পানি শুষে নেয়ার পথ বন্ধ। পানি সরে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অর্থাৎ নর্দমা ও খাল বেদখল হয়ে গেছে। খালগুলো হয় ভরাট হয়েছে, নয় আবর্জনা-পলিথিনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক ড্রেনেজব্যবস্থা ধ্বংসের পাশাপাশি অপরিকল্পিত ড্রেনেজব্যবস্থা, বিভিন্ন সংস্থার সংস্কার কাজের কারণে ম্যানহোলের ঢাকনা নষ্ট হয়ে যাওয়া, বৃষ্টির সময় ঢাকনা না খোলা, অপরিকল্পিতভাবে বক্স কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদির কারণে ঢাকায় বৃষ্টি হলেই মানুষ জলাবদ্ধতা ও তীব্র যানজটের শিকার হচ্ছে।
প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য মোট ভূমির ১২ শতাংশ জলাধার প্রয়োজন, কিন্তু ঢাকায় টিকে আছে মাত্র দুই শতাংশ। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নগরীর ৫৮টি খালের মধ্যে ৩৭টির অংশবিশেষ রাজউকসহ তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। ঢাকা ওয়াসার আওতায় ২৬টি খালের মধ্যে যে ক’টার এখনো নিশানা আছে, সেগুলোও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পলিথিন আর ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের। এ ক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি, এমন নয়। কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। অবৈধ দখলদারেরা প্রভাবশালী হওয়ায় ওয়াসা কিংবা সিটির পক্ষে খাল উদ্ধারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এর আগে বহুবার জেলা প্রশাসন, ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ খালের দেখভালের সাথে যুক্ত অন্যান্য সংস্থা সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা ও কর্মসূচির মাধ্যমে খাল উদ্ধার করার কথা বলা হয়েছে এবং কিছু চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি।
আইন অনুযায়ী, সব খালের মালিক জেলা প্রশাসন এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ওয়াসা বলছে, তারা ২৬টা খাল জেলা প্রশাসন থেকে বুঝে নিয়েছে এবং শুধু সেগুলোরই সংস্কার করছে, বাকিগুলোর ব্যাপারে তারা জানে না। খালের মালিকানা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। ধারাবাহিক সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবে জনগণের বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও নগরীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরাদ্দ জটিলতার কারণে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ সময়মতো শুরু ও শেষ না হওয়ায় জনগণের অর্থ জলে যাচ্ছে।
ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমত দরকার জনগণের এবং দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। পানিতে ডুবে যাওয়ার পথ তো আমরাই তৈরি করছি। আমাদেরই নিত্যব্যবহৃত পলিথিনে খাল-নর্দমা ভরে গেছে। পলিথিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টির সময় ড্রেন এবং ম্যানহোলের ঢাকনাগুলো সহজে খোলার ব্যবস্থা করতে হবে; বিভিন্ন সংস্থার রাস্তা, ফুটপাথ ইত্যাদি সংস্কারের পর পানি নিষ্কাশনের ঢাকনাগুলো যাতে সংস্কার হয়, তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে। যত্রতত্র বক্স কালভার্ট নির্মাণ, পাম্প দিয়ে পানি সেচে ফেলার চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খাল উদ্ধার ও সংস্কারের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে বর্ষার আগেই খাল ও নর্দমা সংস্কারের কাজ শেষ করতে হবে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে সময়মতো অর্থ ছাড় করতে হবে। তা না হলে আমরা সামান্য বৃষ্টিতেও ঢাকার রাস্তায় পানিতে ডুবে থাকব সেটিই স্বাভাবিক।
চলতি বছর ঢাকা ওয়াসা রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ৭০০ নতুন ক্যাচপিট বসিয়েছে। মেরামত করা হয়েছে পুরনো আরো ৩০০টির মতো। ক্যাচপিট হলো সড়কের পাশে বৃষ্টির পানি প্রবেশের পথ। বৃষ্টির পানি গভীর নর্দমায় প্রবেশের জায়গা হিসেবে পরিচিত এসব ক্যাচপিটের প্রায় অর্ধেক এখন যথাযথ কাজ করছে না।
নতুন ও মেরামত করা ক্যাচপিটগুলোর পেছনে প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। নতুন একটি ক্যাচপিট তৈরিতে গড়ে ২৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন সড়কের কিনারে এগুলো বসানো হয়েছে। কিন্তু সঠিক সংরক্ষণের অভাবে এবং বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিমালিকের নির্মাণকাজের কারণে অনেক ক্যাচপিট বন্ধ হয়ে গেছে। আবার এগুলোর ভেতর থেকে আসা দুর্গন্ধ দূর করতে আশপাশের দোকানি ও বাসিন্দারা পলিথিন ও ছালা দিয়ে ক্যাচপিটের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। এসব কারণে ক্যাচপিটগুলো অকেজো হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ভারী বর্ষণের পর যেসব এলাকায় বেশি পানি জমে থাকে, সেসব এলাকার সড়কে এবার নতুন ক্যাচপিট বসানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক, জিগাতলা কাঁচাবাজার, মতিঝিল, ফকিরাপুল টিঅ্যান্ডটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকা, নটর ডেম কলেজের সামনে, কাকরাইল, শান্তিবাগ, বেইলি রোড, সার্কিট হাউজ রোড, মৌচাক, মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, কাওরান বাজারের ওয়াসা ভবনের সামনে, পুরান ঢাকার অভয় দাস লেন, দয়াগঞ্জ, শহীদ ফারুক সড়ক ও বকশীবাজার এলাকা।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও একটি ক্যাচপিটের রড এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে আছে যে, পানি যাওয়ার পথই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোথাও ক্যাচপিট ছালা আর পলিথিনে ঢাকা। ফকিরাপুল টিঅ্যান্ডটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকা থেকে প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার সড়কে অন্তত ৪০টি ক্যাচপিট বসানো। বেশির ভাগই হয় ইটের টুকরো, নয়তো পলিথিন দিয়ে বন্ধ। শান্তিনগরে ইস্টার্ন প্লাস শপিংমলের কাছের ক্যাচপিট চাপা পড়েছে নির্মাণসামগ্রীর তলায়।
আশার খবর হলো ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়ক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, এখানে বসানো ক্যাচপিটগুলো পরিষ্কার রয়েছে। সেখানে রাপা প্লাজার পাশ থেকে সাত মসজিদ রোড পর্যন্ত এক কিলোমিটার গভীর নর্দমা লাইন করা হয়েছে। ওই নর্দমায় পানিপ্রবাহের জন্য ৫০টির মতো ক্যাচপিট বসানো হয়েছে। এগুলো সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় বলে এলাকাবাসী জানান।
ওয়াসার ড্রেনেজ বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, লোকবলের অভাবে সব ক্যাচপিট সার্বক্ষণিক পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও যতটা সম্ভব রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশনের রাস্তা ও ফুটপাথ সংস্কার, ব্যক্তিগত নির্মাণ এসব কাজের সময় নির্মাণসামগ্রী ক্যাচপিটে পড়ে যায়। পরে সেগুলো আর পরিষ্কার করা হয় না। সবচেয়ে সমস্যা করছে বিভিন্ন এলাকার কিছু বাসিন্দা ও দোকানিরা। দুর্গন্ধ বের হয় বলে তারা প্লাস্টিক পেপার ও ছালা দিয়ে ক্যাচপিট ঢেকে রাখেন। ফলে সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে। বৃষ্টি হলে পানি যখন নামতে পারে না, তখন এলাকাবাসীই বেশি সমস্যায় পড়েন।


আরো সংবাদ



premium cement